Type Here to Get Search Results !

Hollywood Movies

যেভাবে সংক্রমণ ঘটায় করোনা ভাইরাস



পুরো বিশ্বকে পাল্টে দেওয়া ভয়াবহ করোনাভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করে মূলত মুখ, চোখ ও নাক দিয়ে। এসব অঙ্গ দিয়ে ঢুকে এই মারণ ভাইরাসটি কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, তা তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোশাররফ হোসেন

১ এপ্রিল, ২০২০
কালেরকণ্ঠ

মূলত ছড়ায় হাঁচি বা কফের মাধ্যমে
কভিড-১৯ আক্রান্ত কোনো রোগীর হাঁচি বা কফের মাধ্যমে মূলত ভাইরাসটি অন্যজনের দেহে ছড়ায়। এরপর কাছের কোনো লোকের নাক, মুখ বা চোখ দিয়ে দেহের ভেতর প্রবেশ করে। ভাইরাসটি খুব দ্রত নাসারন্ধ্রের মধ্য দিয়ে গলার পেছন দিকের মিউকাস মেমব্রেনে (পিচ্ছিল ঝিল্লি) পৌঁছায়। ভাইরাসটিতে সুচালো আমিষ (স্পাইকড প্রোটিন) আছে, যা মেমব্রেন কোষে আংটার মতো আটকে থাকতে কাজ করে। এই প্রোটিনের মধ্য দিয়েই ভাইরাসটি মানব কোষে নিজের জেনেটিক উপকরণ ঢুকিয়ে দেয়। এই উপকরণই কোষের বিপাকীয় কার্যক্রম ছিনতাই করে দেহের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায়। আস্তে আস্তে ভাইরাসটির সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটতে থাকে এবং আক্রমণের মাত্রা মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যায়।

শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা তৈরি করে

যখনই ভাইরাসটি সংখ্যায় বাড়বে তখনই কোষ ফেটে যায় এবং পাশের কোষগুলোকে সংক্রমিত করে। গলা থেকে ভাইরাসটি হামাগুড়ি দিয়ে ব্রংকিয়াল টিউবে নামতে থাকে। শেষে যখন ফুসফুসে ঢোকে ভাইরাসটির মিউকাস মেমব্রেন উত্তেজিত বা প্রজ্বলিত হয়। তাতে মানুষের অ্যালভিওলাই বা ফুসফুস ঝিল্লি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে কারণে রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ করতে ফুসফুসকে বেশি কাজ করতে হয়। আর যদি ফুসফুস ফুলে যায়, তবে কাজটি আরো অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। ফুসফুসের ফোলা জায়গা তরল ও মৃতকোষে পূর্ণ হয়ে নিউমোনিয়া তৈরি করে। অনেকেরই তখন শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে খুব সমস্যা হয়। ভেন্টিলেটর দরকার হয়। একপর্যায়ে আরো কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করে; অর্থাৎ একুইট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম দেখা দেয়। অর্থাৎ ফুসফুস তখন মাত্রাতিরিক্ত তরলে পূর্ণ হয় সে সময় ভেন্টিলেটর দিয়েও কাজ হয় না, একপর্যায়ে রোগী মারা যায়।

ফুসফুসে আক্রমণ পরিক্রমা

ভাইরাসটি ফুসফুসের উভয় দিকের প্রান্ত (পেরিফেরি) দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। শ্বাসনালি (ট্রাকিয়া) এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় বায়ুপথে আক্রমণ করতে কিছু সময় নেয়। যার কারণে কেবল প্রান্তভাগ পরীক্ষায় অনেক সময় রোগটি ধরা পড়ে না। বিশেষ করে চীনের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে। যার কারণে চিকিৎসকরা রোগীকে হাসপাতালে ভর্তিও নেননি। প্রথম দিকে বলেছিলেন, বাসাবাড়িতে অবস্থান করতে। পরবর্তী সময়ে তা অন্য লোকদের সংক্রমিত করে। এ রকম ভুল আমাদের এখানেও হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

শুধু কি ফুসফুসই আক্রান্ত হয়?

মিউকাস মেমব্রেনকে বাহন করে মলনালি পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে করোনাভাইরাস। তাই ভাইরাসটি পরিপাক প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত কোষগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সে কারণে অনেক রোগীর বদহজম বা ডায়রিয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। আবার ভাইরাসটি রক্তনালিতেও ঢুকে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে কিডনি, হার্ট আর লিভারের মতো অঙ্গকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তবে মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে কি না তা এখনো জানা যায়নি। সার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তা মস্তিষ্কে পৌঁছেছিল।

বিজ্ঞানীরা এখনো অন্ধকারে!

অনেক লক্ষণই এটি সার্স ভাইরাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। যেমন—ইনফ্লুয়েঞ্জা আর নিউমোনিয়া। কিন্তু এখনো ভাইরাসটিকে পুরোটা বোঝার সুযোগ হয়নি।
কোনো কোনো রোগী কয়েক সপ্তাহ একই রকম ভালো থাকার পর হঠাৎ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। অনেক রোগী সুস্থ হওয়ার পর আবার আক্রান্ত হয়েছে এমনও ঘটেছে। একজন রোগীর ঘটনা এমন—তাঁকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। একপর্যায়ে সে তাঁর স্ত্রীকে এসএমএস করে জানায় যে ভালো বোধ করছে এবং ক্ষুধাও পাচ্ছে তাঁর। তারপর রাত ১০টার দিকে হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, লোকটি মারা গেছে। তাই বিজ্ঞানীরা ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন, এর অনেক কিছুই এখনো অজানা।

ঝুঁকি যাঁদের বেশি

যেকোনো ব্যক্তিই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে ষাট এবং সত্তরোর্ধ্বরা চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিশেষ করে যাঁদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টসহ ফুসফুসের রোগ রয়েছে, তাঁদের পক্ষে করোনা সংক্রমণ বেশ আশঙ্কার। পরিসংখ্যান বলছে, এই গ্রুপের লোকজনই বেশি করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং বেশি মারা যাচ্ছেন।
অন্যদিকে শিশু ও মাঝারি বয়সীরা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিতে থাকেন, তবে তাঁরাও যে আক্রান্ত হচ্ছেন না একেবারে তা কিন্তু নয়। সংখ্যাটা নগণ্য এবং তারা সুস্থ হয়ে উঠছেন।

তাপমাত্রা বেশি থাকলে কি করোনার সংক্রমণ কমবে?

প্রথম দিকে একে ভিত্তিহীন বলা হলেও ইদানীং বিশ্বের বিভিন্ন মাইক্রো বায়োলজিস্টরা আশার বাণী শোনাচ্ছেন। তাঁদের ধারণা, তাপমাত্রা বাড়লে করোনা সংক্রমণ অনেকটাই কমবে। চীনের বিজ্ঞানীরাও দেখেছেন, সেখানে শীতে বেশি করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছে। লন্ডনের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ গবেষণা কেন্দ্র পরিচালিত সমীক্ষাও বলছে, শীতকালে রোগীদের শ্বাসনালি থেকে প্রাপ্ত তিন ধরনের ভাইরাস শীতের সময় অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে।  সাধারণত যেকোনো জীবাণু ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে বেশি সক্রিয় থাকে। তাই চলতি বছরের জুনের শেষে কভিড-১৯ এর প্রভাব অনেকটাই কমে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে জেনেটিক পরিবর্তন ঘটিয়ে রূপ বদলিয়ে ভয়ংকর হতে পারে করোনাভাইরাস—এটিই আশঙ্কার বিষয়।

কাপড়ে কি এই ভাইরাস থাকতে পারে?

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কাপড়ের মতো নরম জিনিসের গায়ে করোনাভাইরাস দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে না। ফলে যে কাপড়টি পরিধান করা হচ্ছে এবং তাতে যদি ওই ভাইরাসটি থাকে, সেই জামাটি এক দিন বা দুদিন না পরলে সেখানে ভাইরাসটি জীবিত থাকার আর আশঙ্কা নেই। মনে রাখতে হবে, কভিড-১৯-এর ভাইরাসটি লেগে আছে এ রকম জিনিসে শুধু স্পর্শ করলেই কেউ আক্রান্ত হবেন না। বরং স্পর্শ করার পর তিনি যদি হাত দিয়ে মুখ, নাক অথবা চোখ স্পর্শ করেন, তাহলেই তা দেহে ঢোকার আশঙ্কা থাকে।

টাকার মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে কি?

টাকার মাধ্যমে করোনা ছড়ানোর আশঙ্কার কথা অনেক গবেষণায় বলা হচ্ছে। লেনদেনকারী ব্যক্তি হয়তো করোনাভাইরাস পজিটিভ বা কভিড-১৯-এ আক্রান্ত। এখন তিনি যদি টাকা গণনার সময় মুখের লালা ব্যবহার করেন এবং অপর ব্যক্তি যদি সেই টাকা হাত দিয়ে ধরেন, তবে অপর ব্যক্তিটি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবেন।

কভিড-১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষা কতটা গ্রহণযোগ্য?

কভিডের নমুনা সংগ্রহ করা হয় মানুষের গলা অথবা নাকের তরল থেকে। পরীক্ষাগুলোতে কভিডের আরএনএ খোঁজা হয়। এখনো তিন-চার দিন লেগে যায় ফলাফল পেতে। তবে সময় কমে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ফলাফল যদি পজিটিভ আসে, তবে নিশ্চিত হওয়া যায় মানুষটি আক্রান্ত। আর নেগেটিভ এলে কম নিশ্চিত হওয়া যায় যে সে আক্রান্ত নয়। হয়তো আক্রান্ত ব্যক্তির ওইটুকু নমুনায় ভাইরাসটি নেই। এ কারণে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করা জরুরি।

গন্ধ টের না পাওয়া কি কভিড-১৯-এর উপসর্গ?

রোগী যত বাড়ছে ততই এটি একটি উপসর্গ হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। কারণ ভাইরাল ইনফেকশনে গন্ধ না পাওয়ার রেকর্ড আগে থেকেই আছে আর কভিড-১৯ তো একটা ভাইরাস দিয়েই ঘটে। জার্মানির বেলায় দেখা গেছে, প্রতি দুজনের একজন রোগী গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে। তবে গন্ধ না পাওয়া সাধারণ সর্দি-কাশির রোগীদের ক্ষেত্রেও ঘটে।

রক্তচাপের কোনো কোনো ওষুধ কি সমস্যা বাড়িয়ে দেয়?

এনজিওটেনসিন কনভাটির্ং এনজাইম (এসিই) ইনহিবিটরস এবং এনজিওটেনসিন রিসেপটর ব্লকারস (এআরবি)—রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এবং হৃদরোগের চিকিৎসায় এই দুই ধরনের ওষুধের ব্যবহারই বেশি। ডায়াবেটিক রোগীদেরও এ ওষুধ দেওয়া হয়। করোনা সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি হৃদরোগীদের এসব ওষুধ চালিয়ে যাওয়ার জোর পরামর্শ দিয়েছে এমনকি কভিডে আক্রান্ত হলেও।

করোনা প্রতিরোধে ভিটামিন ‘সি’ কতটুকু কার্যকর?

করোনা প্রতিরোধে ভিটামিন ‘সি’ সাহায্য করতে পারে—এ কথা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে যেকোনো ফ্লুর ক্ষেত্রে ভিটামিন ‘সি’ বেশ কার্যকরী। গত বছর প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, ফুসফুস তরলে পূর্ণ এবং তীব্র শ্বাস-প্রশ্বাস সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের প্রথম চার দিনে উচ্চমাত্রার ভিটামিন ‘সি’ প্রয়োগে কোনো উপকার হয়নি। তবে ২৮ দিনে গিয়ে দেখা গেছে মৃত্যুর হার কমেছে।

কাপড়চোপড় রোদে শুকালে ভালো নাকি ধোয়া?

বাংলাদেশের যেকোনো সাবান দিয়ে কাপড়চোপড় আধাঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে যদি ধোয়া হয়, তাহলে ভাইরাস মারা যায়।

লকডাউন করা হয় কেন? এর নিয়ম কী?

লকডাউন শব্দটি রাজনীতিবিদরা ব্যবহার করেন। এখন এই কথাটি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মানে হলো, যে এলাকায় লকডাউন করা হবে সেখান থেকে কেউ বাইরে যেতে পারবে না। পাশাপাশি কেউ প্রবেশও করতে পারবে না। তবে লকডাউন এলাকায় প্রয়োজনীয় ওষুধের দোকান, নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকানপাট খোলা থাকবে। অন্য সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। বেশিদিন লকডাউন থাকলে করোনাভাইরাসের শৃঙ্খল বা চেইন ভেঙে যায়। তবে এটি ২০-২৫ দিন হলে ভালো হয়।
Tags

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad