কবিতার ব্যাখা
বিষয়: বাংলা
টপিক: আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
ফর: ফার্স্ট/সেকেন্ড ইয়ার/হসচ পরীক্ষার্থী
বাঙালি চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতির রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস 😇😇। আমাদের পূর্বপুরুষেরা অনেক শোষণ, বঞ্চনা আর নিগ্রহ সহ্য করে ইতিহাসে 'বাঙালি' জাতি হিসেবে আমাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন 😔😰। আলোচ্য কবিতাটি তারই সাক্ষ্য বহন করে। বাঙালি জাতির টিকে থাকার ইতিহাস, সর্বোপরি কবিতার শক্তিতে উজ্জ্বীবিত হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিচয় বহন করে কবিতাটি। 😊
এবার শুরু হবে লাইন বাই লাইন এক্সপ্ল্যানেশনঃ
.
>> 'আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল।' <<
ব্যাখাঃ এখানে কবি তাঁর 'পূর্বপুরুষ' বলতে আমাদের সবার পূর্বপুরুষ তথা বাঙালি জাতির আদি পিতাদের বুঝিয়েছেন। 'করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল'- বলতে বুঝানো হয়েছে কৃষিভিত্তিক সমাজের কথা। বুঝানো হয়েছে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এক সমাজের কথা। সে সমাজ যন্ত্রনির্ভর ছিল না। লাঙল দিয়ে কৃষক হালচাষ করত। তাঁর পায়ের তল থেকে যেন উর্বর পলিমাটির সৌরভ ই বের হত। 'রক্তজবার মতো ক্ষত'- বলতে বুঝানো হয়েছে বহিঃশত্রুর আক্রমণের কথা। আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবন মসৃণ ছিল না। বিদেশী বেনিয়া সমাজ এমনকি নিজ দেশের মানুষদের কাছ থেকেও শোষণ-নিপীড়নের শিকার হতে হত তাদের। আর আক্রমণ টা হত পেছন থেকে, কারণ আক্রমণকারীরা ছিল কাপুরুষ। সম্মুখ সমরে বাঙালিদের রুখে দেয়ার সাহস তারা মোটেও রাখত না। তাই 'পিঠে' রক্তজবার মত লাল ক্ষতের কথা বলা হয়েছে।
.
.
>> 'তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।' <<
ব্যাখাঃ কবির কবিতাটি 'মাটির কাছাকাছি মানুষদের' নিকট উৎসর্গীকৃ্ত। তারা অতিক্রান্ত করতেন পাহাড়, অরণ্য এমনকি হিংস্র পশুর আবাসস্থল ও। তারা পতিত জমি আবাদ করে সবুজে শ্যামলে ফুটিয়ে তুলতেন। তারা বলতেন কবি ও কবিতার কথা। প্রত্যেকেই যেন এক একজন কবি। আর তাদের লেখা কবিতাই যেন আজকের ইতিহাস।
.
.
>> 'জিহবায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।' <<
ব্যাখাঃ কবির কাছে শুধু কবিতাই সত্য, আর এই সত্যই হল শক্তি। যা কবিকে সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। ইতিহাস থেকে কবি সামনে এগিয়ে যাওয়ার রসদ পান। আর সেই ইতিহাস ই হল কবিতা, যা কবির পূর্বপুরুষেরা লিখে গেছেন।
.
.
>> 'যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।' <<
ব্যাখাঃ কবিতা শুনতে না চাওয়া মানুষগুলো ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে। ঝড়ের আর্তনাদ রুপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যার প্রকৃত অর্থ হল কষ্টের আর্তনাদ। সে হবে দিগন্তের অধিকার বঞ্চিত- এর অর্থ হল সে স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে পারবে না। আজন্মই ক্রীতদাস থেকে যাবে।
.
.
>> 'আমি উচ্চারিত সত্যের মতো
স্বপ্নের কথা বলছি।
উনোনের আগুনে আলোকিত
একটি উজ্জ্বল জানালার কথা বলছি।' <<
ব্যাখাঃ সচরাচর জানালা আলোকিত হয় সূর্যের আলোয়। কিন্তু এখানে উনোনের আগুন বলা হয়েছে, ইহা রুপক অর্থে ব্যবহৃত। বাস্তবিক অর্থ হল- বদ্ধ জীবন থেকে মুক্ত জীবনের প্রত্যাশা। উনোনের আগুন একটি বদ্ধ জীবন। এর আলোয় যখন জানালা উজ্জ্বল ও আলোকিত হয়, তখনই মুক্ত জীবন লাভ করা সম্ভব হয়।
.
.
>> 'আমি আমার মায়ের কথা বলছি,
তিনি বলতেন প্রবহমান নদী
যে সাঁতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে।' <<
ব্যাখাঃ যে সাঁতার জানে না, তাকেও নদীর ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যায়, এখানে নদীর ঢেউ বলতে বুঝানো হয়েছে আশা। 'মানুষ বাচে আশায়'- অর্থাৎ যে মানুষটি হাল ছেড়ে দেয় তাকেও আশা জীবিত করে রাখে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ দেয়।
.
.
>> 'যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নদীতে ভাসতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না।' <<
ব্যাখাঃ একটা মুক্ত জীবন যেভাবে থাকে- নদী আর মাছের সাথে সখ্যতা, মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শোনা, এসব কিছুই সম্ভব না যদি না একজন মানুষ কবিতা না শুনতে পারে। অর্থাৎ পরাধীনতার শেকল থেকে বেরিয়ে না আসতে পারে। যেটা পেরেছিল আমাদের পূর্বপুরুষেরা দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে।
.
.
>> 'আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষদের কথা বলছি।
আমি বিচলিত স্নেহের কথা বলছি
গর্ভবতী বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি।' <<
ব্যাখাঃ পূর্বপুরুষদের সংগ্রামের ইতিহাস ই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিপ্রত্যাশী মানুষের আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় তাদের স্বজনরা উদ্বিগ্ন হন, ভালোবাসা আর শঙ্কা তখন একসাথে মিশে যায়। এটাকেই 'বিচলিত স্নেহ' বলা হয়েছে। গর্ভবতী বোনের মৃত্যু প্রমাণ করে মুক্তিকামী জাতিকে দমিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা। যাতে করে পরে কেউ মুক্তি কামনা করতে না পারে।
.
.
>> 'ভালোবাসা দিলে মা মরে যায়
যুদ্ধ আসে ভালোবেসে
মায়ের ছেলেরা চলে যায়,
আমি আমার ভাইয়ের কথা বলছি।' <<
ব্যাখাঃ এখানে 'আত্মিক মৃত্যুর' কথা বুঝানো হয়েছে। দেশমাতাকে ভালোবেসে যখন কেউ মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়, তখন মায়ের মনে এক চরম বেদনা অনুভূত হয়। সেই বেদনা আরো দীর্ঘায়িত হয় যখন তারই ছেলে/মেয়ে যুদ্ধে মারা যায়। তখন মায়ের এক প্রকার 'আত্মিক মৃত্যু' ঘটে। দেশকে ভালোবাসলে দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে হয়। তাই বলা হয়েছে 'যুদ্ধ আসে ভালোবেসে।'
.
.
>> 'যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সূর্যকে হৃদপিণ্ডে ধরে রাখতে পারে না।' <<
ব্যাখাঃ কবিতা শুনতে না জানা মানুষগুলো সন্তানের জন্য নিজের জীবন দিতে পারে না। নিজের জীবনই তখন তাঁর কাছে অধিক মূল্যবান মনে হয়। সে তখন যুদ্ধে ও যেতে ভয় পায়। সূর্য সকল শক্তির উৎস। হৃদয়ে সূর্যকে ধারণ করার অর্থ হল একজন মানুষ সবদিক দিয়ে শক্তিশালী, তেজস্বী। মুক্তি তখন অনিবার্য। কিন্তু কবিতা না শুনতে চাওয়া মানুষগুলো সেটাও পারে না। নিজেদের অন্তরকে শক্তিশালী না করতে পারায় পরাধীনতা তাদের জেঁকে বসে।
.
.
>> 'আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষদের কথা বলছি।
তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।' <<
ব্যাখাঃ আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন পরাধীন হুকুমের গোলাম। বেনিয়ার জাত তথা শোষণকারীরা বারবার পেছন থেকেই হামলা করত, প্রতিহত করত আর দমিয়ে রাখতে চাইত এদেশের স্বাধীনতার প্রদীপকে।
.
.
>> 'যে কর্ষণ করে
শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে।
যে মৎস্য লালন করে
প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে।
যে গাভীর পরিচর্যা করে
জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।
যে লৌহখন্ডকে প্রজ্বলিত করে
ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করবে।' <<
ব্যাখাঃ এখানে পরিশ্রমের মহিমা সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। মাটি যে কর্ষণ করবে, সেই ভালো শস্যের সম্ভারে সমৃদ্ধ হবে। মাছের পরিচর্যা করলে নদীই তাকে পুরস্কৃত করবে। গাভীর ভালো পরিচর্যা করলে জননীর আশীর্বাদ তাকে অনেক দিন বাচিয়ে রাখবে। ইস্পাতে শান দিলে সেই সশস্ত্র হবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন এমনই। ফলে তাদের পরিশ্রমের ফল হিসেবে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা।
.
.
>> 'দীর্ঘদেহ পুত্রগণ
আমি তোমাদের বলছি।
আমি আমার মায়ের কথা বলছি
বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
ভাইয়ের যুদ্ধের কথা বলছি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি।' <<
ব্যাখাঃ এখানে কবি আবারও পূর্বপুরুষদের শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস নিয়ে এসেছেন।
.
.
>> 'আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।
সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালোবাসার সুকন্ঠ সংগীত কবিতা
জিহবায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।' <<
ব্যাখাঃ কবি এখানে কবিতাকেই সকল মুক্তির উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান- মানে বুঝানো হয়েছে কবিতার শক্তিই সম্মুখ সমরে সশস্ত্র হয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। ভালোবাসার সুকন্ঠ সংগীত ও কবিতা। প্রতিটি মুক্ত শব্দ যা আমাদের দ্বারা উচ্চারিত হয়- সেটিও কবিতা, এখানে কবিতা হয়ে উঠেছে মুক্তি, প্রতিরোধ ও জাতীয়তাবোধের প্রতীক।
.
.
>> 'আমরা কি তাঁর মতো কবিতার কথা বলতে পারবো
আমরা কি তাঁর মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো।'
ব্যাখাঃ এখানে কবি একটা প্রশ্ন রেখে গেছেন আমাদের কাছে। পূর্বপুরুষরা নানা শোষণ বঞ্চনা স্বীকার করে যে স্বাধীনতা ও মুক্ত বাতাস আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন, আমরা কি তা অক্ষত রেখে সামনে এগিয়ে যেতে পারব? আমরা ও কি পারব কবিতার শক্তিতে জ্বলে উঠতে? উজ্জ্বীবিত হতে?
.
.
কবিতাটি একটু কঠিন হলেও এর গঠন ও কাহিনীগত প্রেক্ষাপট খুবই সহজ। দেখো, অনেক কষ্ট করে এতক্ষণ ধরে টাইপ করলাম। যদি নিজেদের নামে চালিয়ে দাও, বা কার্টেসি ছাড়া চালিয়ে দাও, এরকম পোস্ট লিখতে নিরুৎসাহিত ফিল করব 😪😪। আশা করি কেউ এই কাজ টা করবা না। এতটাও ব্যক্তিত্বহীন অন্তত এই গ্রুপে নেই এটাই আশা করব 🙂🙂। শেয়ার করে বন্ধুদের মাঝে ছড়িয়ে দাও। 😎
সজিব দত্ত
উইং হেড, এডুকেশন ও রিসার্চ
সিলসা
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।