আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করে যেসকল ভু-কৌশলগত জায়গা, তারই একটা হলো সুয়েজ খাল। এই কৃত্রিম খাল ভূমধ্যসাগরকে লোহিত সাগরের সাথে যুক্ত করেছে। প্রতিদিন প্রায় ৭০টি আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল করে সুয়েজ খালে। সুয়েজ খাল খননের আগে ইউরোপের জাহাজগুলোর দক্ষিণ এশিয়ায় আসতে সময় লাগত ৪০-৫০ দিন। আর পাড়ি দিতে হতো অতিরিক্ত সাত হাজার কিলোমিটার পথ। কিন্তু সুয়েজ খাল ব্যবহার করে জাহাজগুলো মাত্র ২০ দিনে দক্ষিণ এশিয়ায় পৌঁছতে পারে।বলা হয়ে থাকে এর পরপরই ব্রিটেনের রাজত্ব বহুগুন বেড়ে যায় ভারতবর্ষের উপর ।
১৮৫৪ সালে ফরাসি প্রকৌশলী ফার্দিনান্দ ডি লেসেপ্স এর নেতৃত্বে মিসর ও সুদানের শাসক সাইয়েদ পাশার আমলে ১৮৫৯ সালে খননকাজ শুরু হয়। ১৮৬৯ সালে খনন সম্পন্ন হলে তা সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় ।
ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রনঃ
১৮৭৫ সালে মিসর অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডিজরেইলি মিসরের শাসক ইসমাইল পাশার কাছ থেকে ৪০ লাখ পাউন্ড স্টার্লিংয়ের বিনিময়ে ব্রিটেন সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বসে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটেন সুয়েজ খালের নিরাপত্তার অজুহাতে মিসরে সেনা মোতায়েন করে যা ১৯৫৬ সালের ১৩ জুলাই পর্যন্ত বহাল থাকে
সুয়েজ খাল নিয়ে মিসরের রাজনীতিঃ
জামাল আবদেল নাসের এর নেতৃত্বে ১৯৫২ সালের মিশরীয় বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছিল যার মধ্য দিয়ে মিশরের তৎকালীন রাজা প্রথম ফারুকের পতন ঘটে এবং ১৯৫৪ সালে নাসের মিশরের ক্ষমতা গ্রহণ করেন । নাসেরের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল প্যান-আরবিজম বা সর্ব-আরববাদ। তিনি দেশটির উন্নয়নের অংশ হিসেবে নীলনদের উপর আসওয়ান বাঁধ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন যার অর্থায়ন করার কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রিটেন। কিন্ত মিশরের সোভিয়েত ব্লকের দিকে ঝুকে যাওয়ার অভিযোগে তারা সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। কারন ১৯৫৫ সালের সেপ্টেম্বরের একটি সোভিয়েত-মিশর অস্ত্র চুক্তি সম্পন্ন হয় এবং গণচীনের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন মিশর ।
ফলে ১৯৫৬ সালের ২৬ জুলাই সুয়েজ খাল জাতীয়করণের ঘোষণা দেন নাসের । বলা হয়, আসওয়ান হাইড্যাম্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করতে অস্বীকৃতি জানানোয় বিপাকে মিসর সরকার। প্রেসিডেন্ট নাসের আলেকজান্দ্রিয়ার মানশীয়া স্কোয়ারে এক সমাবেশে মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে ঘোষনা করেন , সুয়েজ খাল থেকে অর্জিত আয় দিয়ে অসওয়ান বাধ নির্মান করা হবে ।
সুয়েজ খাল দখলে ইসরায়েল আর ইঙ্গ-ফরাসি বাহিনীর হামলাঃ
সুয়েজ খাল জাতীয়করণের পর ব্রিটেনের ব্যবসা বাণিজ্য ও ঔপনিবেশীক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্থ হয় । ১৯৫৬ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে একটি গোপন সেভার্স চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল আর সম্মিলিত ইঙ্গ-ফরাসি বাহিনী অপারেশান কাদেশ , অপারেশান মাস্কেটিয়ার , অপারেশান টেলিস্কোপ নামে সিনাই উপদ্বীপে এবং কায়রোতে বিমান হামলা শুরু করে । অন্যায় এই হামলার প্রতিবাদে সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন হামলা বন্ধ না করলে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন আক্রমণ চালাচ্ছিল হাঙ্গেরির উপর। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার ব্রিটেন,ইসরায়েলের উপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে লাগলেন, যেন তারা সুয়েজ খাল থেকে তাদের সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন আচরণের মূল কারণ ছিল স্নায়ুযুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই চাইছিল না সুয়েজ সংকটকে কেন্দ্র করে সোভিয়েতদের সাথে তাদের সম্মুখ সমরে লড়াই বাধুক এবং পুরো মধ্যপ্রাচ্য সোভিয়েত ব্লকে চলে যাক ।
যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি জাতিসংঘও তিন আক্রমণকারী পক্ষকে সরে আসতে তাগাদা দিচ্ছিল। বৈশ্বিক প্রতিবাদ ও ৪ নভেম্বরের জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ১২ নভেম্বর ১৯৫৬ তারিখে হামলা বন্ধ করে ব্রিটিশ-ফরাসি-ইসরায়েলি বাহিনী।সুয়েজ খালে মোতায়েন করা হয় জাতিসংঘের বাহিনী ।
বিশ্বজুড়ে ব্রিটেনের রাজত্বের দিন শেষঃ
সামরিক দিক দিয়ে সুয়েজ খাল দখল ছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের জন্য বিরাট বিজয় কিন্ত রাজনৈতিক দিক থেকে তা ছিল নজিরিবিহীন বিপর্যয় । স্পষ্ট হয়ে গেল, দ্বিতীয় বিশযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের বিশ্ব রাজনীতিতে গ্রেট ব্রিটেনের আর কোনো প্রভাব-প্রতিপত্তিই অবশিষ্ট নেই। পরাশক্তি এখন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন, তাই অন্য সব দেশকে তাদের মন যুগিয়েই চলতে হবে। সুয়েজ সংকটের পরবর্তী দশকে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের অবশিষ্ট ঔপনিবেশগুলো স্বাধীন হয়ে যায় ।
সুয়েজ সংকট নিরসনের অব্যবহিত পরেই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন অ্যান্থনি ইডেন। অপরদিকে এই সংকটের সূত্র ধরে মিশরসহ গোটা আরব বিশ্বেই তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন নাসের এবং তার প্যান-আরবিজম মতবাদ এগিয়ে নিতে সহায়তা করে ।। কেননা সুয়েজ খালের সূত্র ধরে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা চলছিল, তা বানচাল করে দিতে সক্ষম হন তিনি। তাই তার ভাগ্যে জুটতে থাকে বীরোচিত সম্মাননা।
বর্তমান অবস্থাঃ
নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা হচ্ছে, বর্তমানে কী অবস্থা সুয়েজ খালের? এখনো উন্মুক্ত রয়েছে খালটি, এবং সকল দেশের জলযানই অবাধে যাতায়াত করতে পারে এই খালের উপর দিয়ে। বর্তমানে খালটির মালিক ও পরিচালকের ভূমিকায় রয়েছে মিশরের সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ।বছরে প্রায় ২৫ হাজার জাহাজ সুয়েজ খাল ব্যবহার করে। এর বিনিময়ে মিসর ৪৭৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব উপার্জন করে।
//কোন সাজেশান থাকলে কমেন্টে জানাবেন ।
সুত্রঃ ১। বিভিন্ন ব্লগ , দেশীয় ,আন্তর্জাতিক গনমাধ্যম থেকে সংগৃহিত , অনুদিত,সম্পাদিত একটি লিখা। কপি করলে কার্টেসি দিতে ভুলবেন না //
মুহাম্মদ ইরফান উদ্দীন
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা
৩৭ তম বিসিএস নন-ক্যাডার
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।